সুনামগঞ্জ , বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ , ১ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
নদী ভাঙন আতঙ্কে সুরমাপাড়ের মানুষ জলমহাল শুকিয়ে মাছ ধরা যাবে না : জেলা প্রশাসক জেলা প্রশাসকের আশ্বাসে নৌ-ধর্মঘট প্রত্যাহার আয়নাঘর পরিদর্শনে প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি’র সমাবেশে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সিএনজি-ইজিবাইক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৮ জামালগঞ্জে যুগান্তরের রজতজয়ন্তী উদযাপন টাঙ্গুয়ার হাওরে লাগানো হবে ৩০ হাজার হিজল-করচ ‘আশা’র প্রতিষ্ঠাতা সফিকুল হক চৌধুরী’র মৃত্যুবার্ষিকী পালিত সীমান্ত পেরিয়ে কয়লা আনতে গিয়ে শ্রমিকের মৃত্যু নিখোঁজ যুবকের লাশ মিলল নদীতে স্বজনদের দাবি পরিকল্পিত হত্যা এবারও আসছে তীব্র তাপপ্রবাহ, নেই তেমন প্রস্তুতি ফারিহা একাডেমির বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সম্পন্ন পাটলাই নদীতে নাব্যতা সংকট : নৌজটে দুর্ভোগ, লোকসান শান্তিগঞ্জে বিলের পানিতে ফসলডুবির শঙ্কা ঢিলেঢালাভাবে চলছে বাঁধের কাজ, বিল ছাড়ে বিলম্বকেই দায়ী করছে পিআইসি শাল্লায় বাঁধের কাজ পরিদর্শনে জেলা প্রশাসক শুরু হলো সিলেট রেঞ্জ পুলিশ আন্তঃচ্যাম্পিয়নশিপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট জামালগঞ্জে অগ্নিকান্ডে দোকান, স’মিল ভস্মিভূত নর্থ ইস্ট আইডিয়াল কলেজে ‘তারুণ্যে উৎসব’ উদযাপিত
জামালগঞ্জে ফসলরক্ষা বাঁধ

ঢিলেঢালাভাবে চলছে বাঁধের কাজ, বিল ছাড়ে বিলম্বকেই দায়ী করছে পিআইসি

  • আপলোড সময় : ১১-০২-২০২৫ ০৮:৪১:৪১ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ১১-০২-২০২৫ ০৮:৫২:০৯ পূর্বাহ্ন
ঢিলেঢালাভাবে চলছে বাঁধের কাজ, বিল ছাড়ে বিলম্বকেই দায়ী করছে পিআইসি ছবি: সম্প্রতি নির্মাণাধীন গনিয়ার বিল ক্লোজার সংলগ্ন নদী ভাঙনের চিত্র।
মো. বায়েজীদ বিন ওয়াহিদ::
জামালগঞ্জে চলতি মৌসুমে বোরো রোপণ শেষ পর্যায়ে গেলেও হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ এখনো শেষ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি। কিছু প্রকল্পে এখনো ঢিলেঢালাভাবেই চলছে কাজ। এতে দুশ্চিন্তায় ভোগছেন হাওরের হাজারো কৃষক। কারণ হাওরের যে কোনো একটি বাঁধ দুর্বলভাবে নির্মাণ হলে সম্পূর্ণ হাওরই ঝুঁকিতে পড়ে যায়। যদিও নীতিমালা অনুযায়ী গেল বছরের ১৫ ডিসেম্বর বাঁধের কাজের উদ্বোধন করেছে উপজেলা কাবিটা স্কিম বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটি। কিন্তু বাস্তবে উদ্বোধনের প্রায় ২ মাস হলেও এখনো অধিকাংশ বাঁধে ৬০ ভাগ কাজই বাস্তবায়ন হয়নি বলে দাবি কৃষকদের। তবে উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি ৭০ ভাগ কাজ শেষ।
এদিকে যে বাঁধগুলোতে কাজ হয়েছে, তাতে অভিযোগ রয়েছে কিছু কিছু বাঁধের গোড়া থেকে মাটি উত্তোলনসহ অক্ষত বাঁধে ঘষামাজা দিয়ে কোনো রকম মাটি ফেলে সময় ক্ষেপণ করা হচ্ছে। এতে করে একমাত্র বোরো ফসলের উপর নির্ভরশীল হাওরাঞ্চলের কৃষকগণ রয়েছেন চরম দুশ্চিন্তায়। এছাড়াও সচেতনমহলে ক্ষোভ রয়েছে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেখিয়ে সরকারের বিপুল অর্থ তছরুপের প্রক্রিয়া করা হয়েছে।

গত দুই দিন উপজেলার একাধিক হাওর ঘুরে দেখা যায়, উদ্বোধনের প্রায় ২ মাস হওয়ার পরও অনেক বাঁধেই সন্তোষজনক কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। একাধিক বাঁধে দেখা মেলেনি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির কাউকে। এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম জনি ৫শ টাকার পরিবর্তে প্রতি প্রকল্পের সাইনবোর্ড বাবদ খরচ নিয়েছেন ২ হাজার টাকা করে। অর্থাৎ ৪০টি পিআইসির সাইনবোর্ড বাবদ খরচ নেয়া হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্রায় বাঁধে দৃশ্যমান নেই প্রকল্পের সাইনবোর্ড। তবে কিছু প্রকল্পে সাইনবোর্ড পাওয়া গেলেও একাধিক সাইনবোর্ডে পিআইসি কমিটির সভাপতির নাম ও মোবাইল নাম্বার লেখা ছিলো ভুল।

চলতি বছর উপজেলার পাগনা ও হালির হাওরসহ ছোট বড় ৭টি হাওরের মোট ৪০টি পিআইসির মধ্যে কিছু প্রকল্পে মাটির কাজ প্রায় শেষের দিকে হলেও একাধিক প্রকল্পে এখনো মাটির কাজই চলছে ধীরগতিতে।

এদিকে হালির হাওরের ১২নং প্রকল্পে নীতিমালা উপেক্ষা করে বাঁধের বিভিন্ন স্থানে উপরে মাটির প্রলেপ দিয়ে ভেতরে দেয়া হয়েছে বালুমাটি। যা বৃষ্টি ও অকাল বন্যার পানির চাপে ভেঙে যাওয়ার শতভাগ আশঙ্কা রয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি পিযুষ তালুকদারের কাছে বালু কেন দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা ভুলবশত হয়ে গেছে। আমি এগুলো সরিয়ে এটেল মাটি দিয়ে পুনরায় বাঁধ বেঁধে দিবো। ১৭নং প্রকল্পে মাটি ফেলা হয়েছে, তবে তাতে বাঁধের ভেতরে বড় বড় মাটির চাকা রয়েছে। এগুলো ভেঙে না দেওয়াতে পানি লিক করে হাওরে প্রবেশ করার ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়াও হালির হাওরের ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার গনিয়ারকাড়া প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও দুরমুজ, জিওটেক্স ও দুর্বাঘাস লাগানো বাকি রয়েছে। এই ক্লোজারটির পূর্ব পাড়ে গভীর ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে। ক্লোজার বাঁধ টেকসই রাখতে ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে মনে করছেন স্থানীয় কৃষকগণ। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড সঠিক সময়ে প্রকল্পের অর্থ ছাড় না দেওয়াতে মাটি ফেলা বাঁধে মাটির কমপেকশন, দুরমুজ ও দুর্বাঘাস লাগাতে পারছেন না পিআইসি।
এ ব্যাপারে হালির হাওরের ২১নং পিআইসি কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, আমার প্রকল্পের বাজেট প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা। কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত মাত্র পেয়েছি ২ লাখ ৬০ হাজার টাকার মত। তারপরও আমি মাটির কাজ শেষ করেছি। তাছাড়া সামনে দুরমুজ ও দুর্বাঘাসের অনেক কাজই বাকি রয়েছে। এখনো মাটি কাটার বেকু মেশিনের ৫ লক্ষ টাকা ঋণী আছি। অপরদিকে রফিকুল ইসলাম তালুকদারের ছোট ভাই একই হাওরের ১৪নং প্রকল্পের সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন তালুকদার জানান, তার প্রকল্পে এখনো পুরোপুরি মাটি ফেলতে পারেননি। তিনি আরো বলেন, আমার প্রকল্পের সাইডে মাটির নিচে বিভিন্ন গাছের গুঁড়ি থাকায় মাটির কাজ অনেক কষ্টকর। এছাড়াও অনেক দূর থেকে মাটি আনতে হয়। তবে আমি চেষ্টা করছি তাড়াতাড়ি মাটির কাজ শেষ করার। এছাড়াও আর্থিক সংকটে ভুগছি। আরেকটি বিল ছাড় দিলে হয়তো দ্রুত গতিতে কাজ করতে পারবো।
এদিকে উপজেলার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পাগনার হাওরের বোগলাখালী (কাইল্যানির খাল) ক্লোজার দ্রুত মাটির কাজ শেষ করলেও এখনো বাকি রয়েছে স্লোপ, বাঁশ, দুরমুজ ও জিওটেক্সসহ গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য কাজ। সময় হাতে বাকি আছে আর মাত্র ১৮ দিন।
এছাড়া পাগনার হাওরের ৩৪ নং প্রকল্পে প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা অতিরিক্ত বরাদ্দ বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট সচেতন কৃষক। এই বাঁধে এত টাকার মাটি কখনোই লাগার কথা না জানিয়ে আবুল কালাম নামের এক কৃষক জানান, গত কয়েক বছর যাবত এই বাঁধের মাটি জমে জমে স্থায়ী বাঁধই হয়ে গেছে এটি। তেমন ক্ষতি হয়নি এবছর। বাঁধটি প্রায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগের মত অক্ষত রয়েছে। তারপরও এত টাকা বরাদ্দ দেয়া সরকারের টাকা নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়।

পাগনার হাওরের আরেক কৃষক আলী হোসেন বলেন, প্রতি বছর হাওরের বাঁধ নিয়ে আমরা চিন্তায় থাকি। কোনো বছরই বাঁধের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। ফলে প্রতি বছরই আগাম বন্যায় কোনো না কোনো হাওরের ধান নষ্ট হয়। তাছাড়া এবছর আমাদের পাগনার হাওর থেকে সঠিক সময়ে পানি নিষ্কাশন না হওয়াতে বিপাকে রয়েছে শতশত কৃষক। এখনো রোপণে অনিশ্চয়তা রয়েছে আমাদের অনেক বোরো জমি।

জানাযায়, গত ২০১৭ সালের ফসলহানির পর থেকে প্রতি বছরের আগাম বন্যা থেকে হাওরের বোরো হাওরের ফসল রক্ষার জন্য ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে স্থানীয় কৃষকদের দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে নির্মাণ করা হয় বাঁধ। সংশোধিত নীতিমালায় ১৫ ডিসেম্বর বাঁধের কাজ শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করার বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছর জামালগঞ্জের ৪০টি বাঁধ পুনঃনির্মাণ ও সংস্কারের জন্য ৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে কাজ শুরু হওয়ার পর গত প্রায় ২ মাসে একটি মাত্র বিল ছাড় দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যা মূল বাজেটের ২০ থেকে ২২ শতাংশ মাত্র। যা বাস্তবায়নকৃত কাজের তুলনায় যতসামান্য। এতে পিআইসি কমিটির লোকজন বিভিন্নভাবে ধারদেনা করে হাওরের বাঁধ মেরামত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে একাধিক প্রকল্পের লোকজন জানিয়েছেন।
জামালগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও পিআইসি মনিটরিং কমিটির গণমাধ্যম সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় বেড়ি বাঁধের কাজের অগ্রগতি এ বছর ভালো। পিআইসির মাটির কাজ এপর্যন্ত প্রায় ৭০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে বলে আমার ধারণা। তবে এখনো কয়েকটি পিআইসির মাটির কাজ বাকি রয়েছে। অর্থের অভাবে বাঁধের কাজে ধীরগতিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে একাধিক পিআইসি। কৃষকদের ধান ঘরে তোলার আগ পর্যন্ত মনিটরিং কমিটি ও পিআইসি কমিটি তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে।

হাওর বাঁচাও আন্দোলন জামালগঞ্জ উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, হালির হাওরের কিছু কিছু বাঁধ এখনো ধীরগতিতে কাজ হচ্ছে। হালির হাওরের ১২, ১৭নং প্রকল্পে নজরদারি বাড়ানো দরকার। এগুলোতে নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটছে বলে আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। শনির হাওরের ৩ নং প্রকল্প (লালুর গোয়ালা) ক্লোজারে মাটি ফেলার ৬০ ভাগ কাজ শেষ হলেও বাকি সময়ের মধ্যে জিওটেক্স ও অন্যান্য কাজ যথেষ্ট বাকি রয়েছে। যা নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করা সম্ভব না। তাছাড়া যেভাবে মাটি ফেলা হচ্ছে এতে করে বাঁধ দুর্বল ও ঝুঁকির মধ্যে থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন হাওর বাঁচাও আন্দোলনের এই নেতা।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবছর চলতি বোরো মৌসুমে উপজেলার ছোট-বড় ৭টি হাওরে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে ৩৫ হাজার ৩৪২ জন কৃষক বোরো আবাদ চাষ করছেন। বোরো ফসল উৎপাদনে এবার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ দুই হাজার ৪৮৯ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪৭২ কোটি টাকা।

এ ব্যাপারে জামালগঞ্জ উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম জনি জানান, অধিকাংশ প্রকল্পে মাটির কাজ শেষ। কোনো কোনো প্রকল্পে দুর্বাঘাসও লাগানো হয়েছে। তবে দুর্বাঘাস ও মাটির দুরমুজ করতে হয় লেবার দিয়ে। এখানে প্রতিদিন লেবারের একটা খরচ আছে। পিআইসির বিল না হওয়া পর্যন্ত এই কাজগুলো একটু ধীরে ধীরে হচ্ছে। তবে আশা করছি খুব শীঘ্রই দ্বিতীয় ধাপের বিল ছাড় হবে। সবমিলিয়ে কাজের অগ্রগতি ভালো।

জামালগঞ্জ উপজেলা কাবিটা স্কিম বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুশফিকীন নূর বলেন, হাওরের বেড়িবাঁধের কাজ দ্রুত চলছে। প্রায় ৭০ ভাগ কাজ শেষ। বিলের ব্যাপারে জেলা মিটিংয়ে কথা বলেছি। আশা করছি দ্রুত বিল দেয়া হবে।

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স